আমার পথ (আত্মবিশ্বাস জাগরণমূলক প্রবন্ধ)
- লেখক পরিচিতি-
কাজী নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের জাতীয় কবি। তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৪শে মে (১১ই জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬) জন্মগ্রহণ করেন। বাংলা সাহিত্যের ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে তিনি সমধিক পরিচিত।
কবি হলেও সাহিত্যের অন্যান্য শাখায়ও তিনি বিচরণ করেছেন। তাঁর রচিত উপন্যাসের মধ্যে বাঁধনহারা’, ‘মৃত্যু-ক্ষুধা’, ‘কুহেলিকা’ এবং গল্পগ্রন্থের মধ্যে ব্যথার দান’, ‘রিক্তের বেদন’, ‘শিউলিমালা’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যুগ-বাণী, ‘দুর্দিনের যাত্রী’, ‘রুদ্র-মঙ্গল’, ‘রাজবন্দির জবানবন্দি’ তার উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধগ্রন্থ। কাজী নজরুল ইসলাম ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ শে আগস্ট (১২ই ভাদ্র ১৩৮৩) ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।]
- আমার কর্ণধার আমি। আমার পথ দেখাবে আমার সত্য (পরাধীনতা ও দাসত্ববৃত্তি পরিহার)। আমার যাত্রা-শুরুর আগে আমি সালাম জানাচ্ছি- নমস্কার করছি (অসাম্প্রদায়িক মনোভাব) আমার সত্যকে। যে-পথ আমার সত্যের বিরোধী, সে পথ আর কোনো পথই আমার বিপথ নয়। রাজভয়-লোকভয় (রাষ্ট্র ও সমাজের ভয়) কোনো ভয়ই আমায় বিপথে নিয়ে যাবে না। আমি যদি সত্যি করে আমার সত্যকে চিনে থাকি, আমার অন্তরে মিথ্যার ভয় না থাকে, তাহলে বাইরের কোনো ভয়ই আমার কিছু করতে পারবে না।
- যার ভিতরে ভয়, সেই বাইরে ভয় পায়। অতএব যে মিথ্যাকে চেনে, সে মিছামিছি তাকে ভয়ও করে না। যার মনে মিথ্যা (অসত্যের প্রভাব), সে-ই মিথ্যাকে ভয় করে। নিজকে চিনলে মানুষের মনে আপনা-আপনি এত বড় একটা জোর আসে যে, সে আপন সত্য ছাড়া আর কাউকে কুর্নিশ করে না। অর্থাৎ কেউ তাকে ভয় দেখিয়ে পদানত রাখতে পারে না (আত্মবিশ্বাস জাগ্রত করা)। এই যে, নিজকে চেনা, আপনার সত্যকে আপনার গুরু, পথপ্রদর্শক কাণ্ডারি বলে জানা, এটা দম্ভ নয়, অহংকার নয়। এটা আত্মকে চেনার সহজ স্বীকারোক্তি (ব্যক্তিত্ববোধ)। আর যদি এটাকে কেউ ভুল করে অহংকার বলে মনে করেন, তবু এটা মন্দের ভালো (অন্যরা প্রতারিত হবে না)। অর্থাৎ মিথ্যা বিনয়ের চেয়ে অনেক বেশি ভালো। অনেক সময় খুব বেশি বিনয় দেখাতে গিয়ে নিজের সত্যকে অস্বীকার করে ফেলা হয় (ব্যক্তিত্বহীন বিনয়)। ওতে মানুষকে ক্রমেই ছোট করে ফেলে, মাথা নিচু করে আনে। ওরকম বিনয়ের চেয়ে অহংকারের পৌরুষ অনেক-অনেক ভালো।
- অতএব এই অভিশাপ-রথের সারথির (অন্যায়ের বিরুদ্ধে অভিশাপরূপে আবির্ভূত হওয়ায়) স্পষ্ট কথা বলাটাকে কেউ যেন অহংকার বা স্পর্ধা বলে ভুল না করেন (লেখকের কথার অপব্যাখ্যা করায়)। স্পষ্ট কথা বলায় একটা অবিনয় নিশ্চয় থাকে; কিন্তু তাতে কষ্ট পাওয়াটা দুর্বলতা (অন্যায় মেনে না নেওয়ার মানসিকতা)। নিজকে চিনলে, নিজের সত্যকেই নিজের কর্ণধার মনে জানলে নিজের শক্তির ওপর অটুট বিশ্বাস আসে (আত্মজাগরণ)। এই স্বাবলম্বন, এই নিজের ওপর অটুট বিশ্বাস করতেই শেখাচ্ছিলেন মহাত্মা গান্ধীজি। কিন্তু আমরা তার কথা বুঝলাম না, “আমি আছি” এই কথা বলে সবাই বলতে লাগলাম ‘গান্ধীজি আছেন’। এই পরাবলম্বনই আমাদের নিষ্ক্রিয় করে ফেলে।
একেই বলে সবচেয়ে বড় দাসত্ব (মানসিক দাসত্ব)। অন্তরে যাদের এত গোলামির ভাব (পরনির্ভরশীলতা), তারা বাইরের গোলামি থেকে রেহাই পাবে কী করে? আত্মাকে চিনলেই আত্মনির্ভরতা আসে (আত্মশক্তি বৃদ্ধি পায় বলে)। এই আত্মনির্ভরতা যেদিন সত্যি সত্যিই আমাদের আসবে, সেই দিনই আমরা স্বাধীন হব (চিন্তা চেতনায় স্বাধীনতা), তার আগে কিছুতেই নয়। নিজে নিষ্ক্রিয় থেকে অন্য একজন মহাপুরুষকে প্রাণপণে ভক্তি করলেই যদি দেশ উদ্ধার হয়ে যেত, তাহলে এই দেশ এতদিন পরাধীন থাকত না। আত্মকে চেনা নিজের সত্যকে বড় মনে করার দম্ভ আর যাই হোক ভণ্ডামি নয়। এ-দম্ভ শির উঁচু করে, পুরুষ করে, মনে একটা ‘ডোন্ট কেয়ার’-ভাব আনে (ব্যক্তিত্ববোধ জাগ্রত করে)। আর যাদের এই তথাকথিত দম্ভ আছে, শুধু তারাই অসাধ্য সাধন করতে পারবে।
যার ভিত্তি পচে গেছে, তাকে একদম উপড়ে ফেলে নতুন করে ভিত্তি না গাঁথলে তার ওপর ইমারত যতবার খাড়া করা যাবে, ততবারই তা পড়ে যাবে (ভিত্তি দুর্বল থাকায়)। দেশের যারা শত্রু, দেশের যা-কিছু মিথ্যা, ভণ্ডামি, মেকি (মিথ্যা) তা সব দূর করতে প্রয়োজন হবে আগুনের সম্মার্জনা (দৃঢ়তার সাথে ঘষে মেজে পরিষ্কার করা)! আমার এমন গুরু কেউ নেই, যার খাতিরে সে আগুন-সত্যকে অস্বীকার করে কারুর মিথ্যা বা ভণ্ডামিকে প্রশ্রয় দেবে (স্পষ্ট সত্যকে দূরে সরিয়ে গুরুর মিথ্যাকে প্রশ্রয় দিব না)। আমি সে-দাসত্ব (মানসিক দাসত্ব) হতে সম্পূর্ণ মুক্ত। আমি কোনো দিনই কারুর বাণীকে বেদবাক্য (বিনা সমালোচনায় মেনে নেওয়া) বলে মেনে নেব না, যদি তার সত্যতা প্রাণে তার সাড়া না দেয়। না বুঝে বোঝার ভণ্ডামি করে পাঁচজনের শ্রদ্ধা আর প্রশংসা পাবার লোভ আমি কোনো দিনই করব না।
ভুলের মধ্য দিয়ে গিয়েই তবে সত্যকে পাওয়া যায় (ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে)। কোনো ভুল করছি বুঝতে পারলেই আমি প্রাণ খুলে তা স্বীকার করে নেব (উদার মনোভাব)। কিন্তু না বুঝেও নয়, ভয়েও নয়। ভুল করছি বা করেছি বুঝেও শুধু জেদের খাতিরে বা গোঁ বজায় রাখবার (জিদ করে) জন্যে ভুলটাকে ধরে থাকব না। তাহলে আমার আগুন (সত্য প্রতিষ্ঠার আগুন) সেই দিনই নিভে যাবে। একমাত্র মিথ্যার জলই (মিথ্যাকে আঁকড়ে ধরা) এই শিখাকে নিভাতে পারবে। তাছাড়া কেউ নিভাতে পারবে না।
মানুষ-ধর্মই সবচেয়ে বড় ধর্ম (মানুষের মধ্যে সম্প্রীতিবোধ)। হিন্দু-মুসলমানের মিলনের অন্তরায় বা ফাঁকি (মনুষ্যধর্মকে মূল্য না দেওয়া) কোনখানে তা দেখিয়ে দিয়ে এর গলদ দূর করা আমার এ পথের অন্যতম উদ্দেশ্য। মানুষে মানুষে যেখানে প্রাণের মিল, আদত সত্যের (স্বভাবজাত) মিল, সেখানে ধর্মের বৈষম্য (পার্থক্য) কোনো হিংসার দুশমনির ভাব আনে না। যার নিজের ধর্মে বিশ্বাস আছে, যে নিজের ধর্মের সত্যকে চিনেছে, সে কখনো অন্য ধর্মকে ঘৃণা করতে পারে না (অপরের ধর্মকে শ্রদ্ধা করা)। দেশের পক্ষে যা মঙ্গলকর বা সত্য, শুধু তাই লক্ষ্য করে এই আগুনের ঝান্ডা দুলিয়ে পথে বাহির হলাম।
- পাঠ পরিচিতি : প্রবন্ধটি কাজী নজরুল ইসলামের প্রবন্ধগ্রন্থ ‘রুদ্র-মঙ্গল’ থেকে সংকলিত হয়েছে। “আমার পথ” প্রবন্ধে নজরুল এমন এক ‘আমি’র আবাহন প্রত্যাশা করেছেন যার পথ সত্যের পথ; সত্য প্রকাশে তিনি নির্ভীক অসংকোচ। তার এই ‘আমি’-ভাবনা বিন্দুতে সিন্ধুর উচ্ছ্বাস জাগায়।
- আরও পড়ুন- মাসি পিসি গল্পের আলোচনা