বাংলা ব্যাকরণ কীভাবে পড়বেন?
- ‘অ আ ক খ’ দিয়েই শৈশবে আমাদের হাতেখড়ি হয়েছে। বয়সের সাথে সাথে পড়ালেখার পরিধি বেড়েছে। কৈশোরেই আমাদের সাথে ‘বাংলা ব্যাকরণের’ পরিচয় ঘটে। নবম শ্রেণিতে বাংলা ব্যাকরণের বিস্তৃত রূপের সাথে আমরা জানতে পারি। সে যেন এক বিভীষিকা। এই বিভীষিকার ভয় অনেকের সারাজীবন থেকে যায়। কৈশোরে বাংলা ব্যাকরণের প্রতি এমন ভয়ের কিছু কারণ আছে। যথা-
১. অন্যান্য বিষয় যেভাবে বুঝিয়ে বুঝিয়ে পড়ানো হয়, বাংলা ব্যাকরণের ক্ষেত্রে অনেকাংশে সেই নীতি অনুসরণ করা হয় না।
২. ব্যাকরণিক বিষয়াদি না বুঝিয়ে কেবল মুখস্থের প্রতি জোর দেওয়া হয়। ফলে শিক্ষার্থিরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।
৩. অন্যান্য বিষয়ের প্রতি (ইংরেজি-গণিত) যতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়, বাংলা ব্যাকরণের ক্ষেত্রে ততটাই দূরে থাকা হয়।
৪. বোর্ড পরীক্ষায় গাইড থেকে পড়লেই কমন পড়ে যায়। সুতরাং এত কষ্ট করে ব্যাকরণ শেখার প্রয়োজনীয়তা কী?
৫. এছাড়াও অন্যান্য বইয়ের তুলনায় ‘বাংলা ব্যাকরণ’ বইয়ের ভাষা ও উপস্থাপনা সাম্প্রতিক সময়ের প্রেক্ষিতে কিছুটা কঠিন ছিল। - এত সব প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে আমরা ‘মাধ্যমিক’ পাশ করি। কিন্তু শৈশবে শিখিয়ে দেওয়া ‘ব্যাকরণ মুখস্থ’ করার রীতি থেকে সরে আসতে পারি না। যেকোনো বিষয় পড়তে গেলে আমরা ধীরে ধীরে উপরের পর্যায়ে যাই কিন্তু বাংলা ব্যাকরণের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম। যেমন-
ক. মাধ্যমিকের বোর্ড বইতে ব্যাকরণের সব বিষয় আমরা ঠোঁটস্থ করি।
খ. অথচ উচ্চ মাধ্যমিকের সিলেবাসে বাংলা ব্যাকরণের পরিধি অনেক সংকুচিত করা হয়েছে।
গ. আবার এই দুই বছর (উচ্চ মাধ্যমিক) বাদ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি প্রস্তুতিতে সম্পূর্ণ বাংলা ব্যাকরণই পড়তে হচ্ছে।
ঘ. চাকরির পরীক্ষার ক্ষেত্রে ব্যাকরণের প্রায় সব অধ্যায় থেকেই এডভান্স লেভেলের প্রশ্ন আসছে। - এত সব প্রতিবন্ধকতার পর ব্যাকরণ পাঠে আগ্রহ না থাকাটাই স্বাভাবিক। ফলে আমাদের প্রিয় বাংলা ভাষার নিয়ম-কানুন জানতে আমাদের মধ্যেই অনীহা। অথচ আমরা দেদারসে বিদেশি ভাষার ব্যাকরণ আগ্রহ সহকারে পড়ছি। এছাড়াও অনেকের মতে বাংলা ব্যাকরণ পড়ানোর জন্য কোনো যোগ্যতা লাগে না। শুধু মুখস্থ করলেই সব কমন। ফলে অযোগ্য লোকদের হাতে ‘বাংলা ব্যাকরণ’ পড়ে মুমূর্ষু অবস্থায় আছে। আর শিক্ষার্থিদের অবস্থা…
-
কীভাবে বাংলা ব্যাকরণ পড়বেন?
প্রথম কথা হচ্ছে, মানুষের অবস্থা বুঝে সেভাবে পরামর্শ দেওয়া উচিত। সবার জন্য এক প্রতিষেধক নয়। তারপরও এখানে কিছু পদ্ধতি অনুসরণের কথা বলা হচ্ছে। যথা-
- ১. ‘বাংলা ব্যাকরণ বুঝার বিষয় নয় কেবল মুখস্থের বিষয়’ এই কথা সম্পূর্ণভাবে মন থেকে দূরে রাখুন।
- ২. সব অধ্যায় মুখস্থ করার নীতি পরিহার করুন : ব্যাকরণের কিছু অধ্যায় আছে যা মুখস্থ করতে হয়। যেমন- পরিভাষা, সমার্থক শব্দ, বাগধারা ইত্যাদি। যে অধ্যায়গুলো মুখস্থ করার সেগুলো মুখস্থ করুন। কিন্তু ব্যাকরণের যে অধ্যায়গুলো বুঝে বুঝে পড়ার তা কখনোই না বুঝে মুখস্থ করা উচিত নয়। যেমন- সন্ধি, সমাস, কারক, ধাতু, প্রত্যয়, ধ্বনি পরিবর্তন ইত্যাদি। একটু কষ্ট হলেও এবং ধীরগতিতে হলেও বুঝে বুঝে পড়ুন।
- ৩. গণিত পড়ার নীতি অনুসরণ করুন : গণিত পড়ার ক্ষেত্রে আমরা কিছু নিয়ম পড়ি। তারপর সেই নিয়ম প্রয়োগ করে আমরা অধ্যায়ের গণিতগুলো শেষ করি। এরপর গণিত যেন ভুলে না যাই তার জন্য চর্চা অব্যাহত রাখি।
প্রতিটি ভাষার ব্যাকরণই বুঝে পড়ার বিষয়। আমরা বাংলা ব্যাকরণ পড়ার ক্ষেত্রে নিয়মগুলো না পড়েই প্রশ্ন সমাধানে মগ্ন হই (সময় নেই বলে)। এরপর একদিন খুব জোশে কিছু সময় ব্যাকরণ পড়লেও পরের কয়েকদিন আর খবর থাকে না। ফলে ‘যেই লাউ সেই কদু’ টাইপের অবস্থা হয়। আর ‘যত দোষ নন্দঘোষ’ এই নীতি অনুসরণ করে নিজের দোষ ঢেকে বলি ‘এই বিষয় যে কেন পরীক্ষায় আছে? কিছুই বুঝা যায় না।’ শরৎচন্দ্রের ভাষায় বলতে হয় ‘অমন বিশ্রী বিষয় ছাড়িয়া দেওয়াই কর্তব্য’।
- ৪. বুঝার সাথে সাথে চর্চা অব্যাহত রাখুন : মনে করুন আপনি ‘সন্ধি’ অধ্যায় পড়েছেন। এখন বইয়ে সন্ধি অধ্যায়ের শেষের প্রশ্নগুলোর ৮০% আপনি পারবেন। প্রশ্ন হচ্ছে, এখন তো পারছেন পরে পারবেন তো? বা আরও কয়েকটি অধ্যায় পড়ার পর সন্ধি মনে থাকবে তো? তাই নিয়মিত চর্চা অব্যাহত রাখুন। অন্যথায় জানা বিষয় ভুলে গেলে যে কী কষ্ট, তা ভুক্তভোগীই জানেন।
- ৫. কমনের পিছনে ছুটবেন না, প্রতিষ্ঠিত অজ্ঞ ব্যক্তির নিকট পরামর্শ নিবেন না : এই বিষয়টি চাকরিপ্রার্থী শিক্ষার্থিদের মাঝে বেশি দেখা যায়। চাকরি না পাওয়ার হতাশা ও পদে পদে প্রতারিত হওয়ায় চাকরিপ্রার্থী শিক্ষার্থিগণের অবস্থা ‘ঘর পোড়া গরু সিঁদূরে মেঘ দেখলে ডরায়’। এজন্য তারা নিজেদের অতি সচেতন পরিচয় দিতে গিয়ে কাউকে বিশ্বাস করে না।
কিন্তু যদি বলা হয়, অমুক বই পড়লে এতগুলো কমন। অমুক বই থেকে অমুক বছরের প্রশ্ন এসেছে। তাহলে আমরা হুমড়ি খেয়ে পড়ি। বুঝি আর না বুঝি তা কিনে পড়া শুরু করি। পরে আফসোস করি। কারণ, ‘আমরা শর্টকাটে সব চাই। এত পরিশ্রমের সময় কোথায়?’
এছাড়াও কোনো ‘নামি দামী’ ব্যক্তি যদি কোনো বই রেফার করে তাহলে তো আর কথাই নেই। ‘অমুকে অমুক বই পড়েছে’ মানে কি সেই বই পড়লে আপনারও হবে। এছাড়াও এই লোকগুলো বিভিন্ন সেমিনারে যে বিষয়ে তার জ্ঞান নেই তাও বলে। কথার কথা, যে বাংলা ব্যাকরণকে যমের মতো ভয় পেত সে ‘বাংলা ব্যাকরণ পড়ার নির্দেশিকা দিচ্ছে’ (কারণ, সফল ব্যক্তিদের কোনো ব্যর্থতা থাকে না)। ব্যাস, আমরা সেটাই অনুসরণ করছি আর এই বিষয়ে অভিজ্ঞ যিনি তাঁর কথা শোনার সময় কোথায়?
- ৬. বিষয়ের গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করুন : প্রায় প্রতিটি পরীক্ষাতেই ‘শুদ্ধিকরণ’ থেকে একটা প্রশ্ন থাকে। সাধারণত আমরা তা মুখস্থ করে যাই। কিন্তু পরীক্ষার হলে এগুলোর অনেক কিছুই মনে থাকে না। অথচ শব্দটা কেন ভুল সেই নিয়ম জানলে কিন্তু আমাদের এই কষ্ট করতে হত না। আর পড়া ভুলে গেলে আমরা ‘উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে’ নীতি অনুসরণ করি।
যেমন- ইংরেজিতে একটা বিষয়ে প্রশ্ন আসে Pinpoint error। আমরা সেই প্রশ্নগুলো কি মুখস্থ করে সমাধান করি? গণিতের উত্তর মুখস্থ করলে কতক্ষণ মনে থাকবে? তাহলে বাংলার ব্যাপারে ‘ডাবল স্ট্যান্ডার্ড নীতি’ কেন? - ৭. কেবল নির্বাচিত অধ্যায় পড়া থেকে বিরত থাকুন : অনেক সময় আলসেমি করে আমরা ‘অধ্যায় নির্বাচন’ করে পড়ি। নিজের মনোমত কিছু অধ্যায় ভয়ে বাদ দেই। এটা আপাত দৃষ্টিতে ক্ষতিকর মনে না হলেও পরে এর প্রভাব পড়ে। কারণ, এই অধ্যায়গুলো নিয়ে ভয় দূর হয় না। মনে একটা সন্দেহ রয়েই যায়, যদি অমুক অধ্যায় থেকে বেশি প্রশ্ন আসে। এছাড়াও পরীক্ষায় সব প্রশ্ন কঠিন হয় না। ১০টি প্রশ্নের মধ্যে ৪টি প্রশ্ন কঠিন হয় কিন্তু এই চারটি প্রশ্নের কারণে বাকি ছয়টিও অনেকে ভুলে যায়।
- ৮. মুখস্থ বিষয়াদি পরীক্ষার আগে পড়ুন : আমরা পরীক্ষার ৬ মাস আগে মুখস্থ বিষয়গুলো পড়ি। আর চর্চা না থাকায় এগুলো ভুলে যাই। এগুলো ভুলে যাওয়া স্বাভাবিক। তাই পরীক্ষার আগ থেকে কিছুটা সময় নিয়ে এগুলো পড়বেন। তাহলে আর ভুলে যাওয়ার হতাশায় ভুগবেন না।
- ৯. জানার জন্য পড়ুন : কেবল পরীক্ষাকে টার্গেট না করে নিজের জানা ও অপরকে জানানোর জন্য পড়ুন। একটি অধ্যায় বুঝতে পারলে অপরকে বোঝানোর চেষ্টা করুন। এতে আপনার অনেক সংশয় দূর হয়ে যাবে। আর জানার জন্য পড়লে পড়ায় আগ্রহ বাড়বে। পরীক্ষাতেও ভালো করবেন।
- ১০. অসীম ইচ্ছে সসীম সুযোগ : একথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, ‘বাংলা ব্যাকরণ’ পড়ানোর ক্ষেত্রে অনেক স্থানেই যোগ্য শিক্ষকের সংকট আছে। কারণ, বাংলা বিষয়কে তাচ্ছিল্য করার কারণে এখন কেউ ‘বাংলা’ পড়াতে চান না। ফলে এই বিষয়ে যোগ্য শিক্ষকের অভাব আছে। তারপরও এই সীমিত সুযোগ নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। ইউটিউব, ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে অনেক ভালো ভালো ক্লাস আছে। সেগুলো দেখলেও অনেক উপকৃত হবেন।